“টেকসই নির্মাণ ও গ্রিন বিল্ডিং” বাংলাদেশের আধুনিক নির্মাণ খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে পরিবেশবান্ধব নির্মাণ পদ্ধতির গুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও এই দিকটি গুরুত্ব পাচ্ছে, যেখানে সরকার ও বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গ্রিন বিল্ডিং তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

এই নিবন্ধে, আমরা বাংলাদেশে টেকসই নির্মাণ ও গ্রিন বিল্ডিং এর প্রয়োজনীয়তা, কার্যক্রম, এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আলোচনা করব।

১. টেকসই নির্মাণের ধারণা এবং গুরুত্ব

টেকসই নির্মাণ বলতে এমন একটি নির্মাণ প্রক্রিয়া বোঝানো হয় যেখানে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এটি এমন একটি নির্মাণ প্রক্রিয়া যেখানে ইকো-ফ্রেন্ডলি উপকরণ, শক্তির দক্ষ ব্যবহার, পানি সঞ্চয়, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রাধান্য পায়। টেকসই নির্মাণের মূল লক্ষ্য হলো পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলা এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা।

বাংলাদেশে টেকসই নির্মাণের গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শহুরে বিস্তার, এবং বর্ধিত স্থাপত্য কর্মসূচী এই খাতে পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষভাবে প্ররোচিত করেছে। দেশের টেকসই ভবন নির্মাণের মাধ্যমে পরিবেশের উপর চাপ কমানো এবং শক্তির সাশ্রয়ী ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত করা সম্ভব হবে।

২. গ্রিন বিল্ডিং এবং এর উপকারিতা

গ্রিন বিল্ডিং বলতে এমন একটি ভবনকে বোঝানো হয় যা পরিবেশের প্রতি যত্নশীলভাবে ডিজাইন এবং নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে শক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার করা হয়। এটি গ্রিন বিল্ডিং সিস্টেমের সাথে একত্রে নির্মিত, যেখানে একটি নির্দিষ্ট বিল্ডিং এর নির্মাণ, ব্যবহার, এবং কার্যক্ষমতার ওপর পরিবেশগত প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।

গ্রিন বিল্ডিংয়ের কিছু উপকারিতা:

  1. শক্তির সাশ্রয়: গ্রিন বিল্ডিং প্রাকৃতিক সম্পদের যেমন, সৌর শক্তি, বাতাসের শক্তি এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তি সাশ্রয়ী ব্যবস্থা তৈরি করে।
  2. পানি সঞ্চয়: জল সঞ্চয় এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পানির ব্যবস্থা গ্রিন বিল্ডিংয়ে প্রাধান্য পায়। ফলে পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা যায়।
  3. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: গ্রিন বিল্ডিংয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি কার্যকরীভাবে বর্জ্য কমানোর মাধ্যমে পরিবেশের উপর চাপ কমায়।
  4. স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা উন্নয়ন: গ্রিন বিল্ডিংয়ে নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ এবং ডিজাইন মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি বেশি যত্নশীল, যা অভ্যন্তরীণ বায়ু মান এবং সাধারণ বাসস্থান পরিবেশ উন্নত করে।

৩. বাংলাদেশের গ্রিন বিল্ডিং উদ্যোগ

বাংলাদেশে গ্রিন বিল্ডিংয়ের ধারণা এবং বাস্তবায়ন এখনো নতুন হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রথম সরকারিভাবে গ্রিন বিল্ডিং উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, এবং এটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং বেসরকারি উদ্যোগগুলো গ্রিন বিল্ডিং-এর প্রচলন এবং বাস্তবায়ন সমর্থন করছে।

৩.১. প্রথম গ্রিন বিল্ডিং প্রকল্প

বাংলাদেশে প্রথম গ্রিন বিল্ডিং প্রজেক্ট হিসেবে ইস্টার্ন সিটি কর্পোরেশন (ইসিএসসি)-র একটি প্রকল্প সফলভাবে কাজ শুরু করেছে। এই প্রকল্পটি একটি আধুনিক গ্রিন বিল্ডিং হিসেবে নির্মিত, যেখানে শক্তির সাশ্রয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

৩.২. বিইএনসি এবং গ্রিন বিল্ডিংয়ের পরিসর

বাংলাদেশে গ্রিন বিল্ডিং-এর মান নির্ধারণে “Building Energy Efficiency and Environment Rating (BEEER)” সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ২০০৭ সালে প্রবর্তিত হয়। এটি বাংলাদেশে গ্রিন বিল্ডিং-এর স্ট্যান্ডার্ড এবং প্রত্যয়ন পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম। এই সিস্টেমটি গ্রিন বিল্ডিং ডিজাইন, নির্মাণ, এবং কার্যক্ষমতার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়া এবং গাইডলাইন প্রদান করে।

৪. টেকসই নির্মাণে ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি

গ্রিন বিল্ডিং এবং টেকসই নির্মাণে ব্যবহৃত কিছু প্রধান প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি নিম্নরূপ:

  1. সৌর শক্তি: সৌর প্যানেল ব্যবহার করে সৌর শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
  2. বাতাসের শক্তি: বাতাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী টারবাইন ব্যবহার করা হয়।
  3. বৃষ্টির পানি সঞ্চয়: বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা তৈরি করা হয়, যা ভবনের পানি চাহিদা পূরণে সাহায্য করে।
  4. পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ: নির্মাণ উপকরণ হিসেবে কাচ, সিরামিক, এবং অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহৃত হয়।

৫. চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পথ

বাংলাদেশে টেকসই নির্মাণ এবং গ্রিন বিল্ডিংয়ের প্রবৃদ্ধি এবং প্রসার সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে উপকরণের খরচ, জনসচেতনতার অভাব, এবং নির্মাণ প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা।

তবে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণার মাধ্যমে টেকসই নির্মাণ এবং গ্রিন বিল্ডিং এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও উন্নতি করতে সক্ষম হবে।

৬. উপসংহার

টেকসই নির্মাণ এবং গ্রিন বিল্ডিং বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্মাণ খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ, শক্তির সাশ্রয়, এবং পানির সঞ্চয়সহ অন্যান্য সুবিধা অর্জনের মাধ্যমে এগুলো বাংলাদেশের জনগণের জন্য উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি করবে। দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে এটি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে, যেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।